ঘানিভাঙ্গা সরিষার তেলের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
সরিষার তেলের উপকারিতা ও ব্যবহার এ দেশে আদিকাল থেকেই সুপরিচিত। একসময় গ্রামাঞ্চলে মানুষজন তেল বলতে শুধু সরিষার তেলকেই চিনতো। একই তেল তারা খাবারে রান্নার জন্য ব্যবহার করতো, আবার গায়েও মাখতো। কারণ সরিষার তেল ত্বক ও স্বাস্থ্য উভয়ের জন্য অনেক উপকারী। এছাড়া এটি খাবারে সুঘ্রাণ এনে খাবারকে সুস্বাদু করে। বিশেষ করে ভর্তা জাতীয় খাবারে সরিষার তেলের কোন জুড়ি নেই।
{getToc} $title={Table of Contents}
সরিষার তেলের
উপকারিতা নিয়ে অনেকের বিষদ জ্ঞান না থাকলেও এর প্রচলন সারা দেশ জুড়ে বিস্তৃত। তবে বর্তমানে
এর ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে সঠিক গুণাগুণ সম্পন্ন ও ভাল মানের
সরিষার তেল পাওয়া যেত তা ছিল ঘানিভাঙ্গা সরিষার তেল। কোল্ড প্রেস এবং কাঠের ঘানিতে
এই তেল ভাঙ্গিয়ে প্রক্রিয়াধীনের মাধ্যমে বাজারজাত করা হত। এতে তেলের মান ও বিশুদ্ধতা
থাকত সর্বোচ্চ। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই কাঠের ঘানির প্রচলন তেমন দেখা
যায় না।
বাজারে সচরাচর
যে সকল সরিষার তেল পাওয়া যায় তার অধিকাংশই ইলেক্ট্রিক প্রেসের মাধ্যমে ভাঙ্গানো। এই
পদ্ধতিতে ভাঙ্গানো তেল বেশি পুড়ে তেলের স্বাদ ও গুণাগুণ উভয়েই প্রভাব ফেলে।অধিক হিটে
ভাঙ্গানো হয় তাই এগুলো তেল নয় মোবাইল পরিণত হয়।ফলে এসকল তেল থেকে ঘানিভাঙ্গা সরিষার
তেলের মত উপকারিতা পাওয়া যায় ই না বরং বড় ধরণের ক্ষতি হয়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকতে পারে
যে, এরপরেও কেন ইলেক্ট্রিক প্রেসের ব্যবহার বেশি?
আসলে কোল্ড
প্রেসে তথা কাঠের ঘানিতে সরিষার তেল ভাঙ্গানো কিছুটা সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ এবং কষ্টকরও
বটে। তাই বর্তমান বাজারে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা ইলেক্টিক প্রেসই
ব্যবহার করে। যাতে কম সময়ে অধিক উৎপাদনের মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। কিন্তু এটা সবাই
জানে ও মানে যে, ঘানিভাঙ্গা সরিষার তেল স্বাদ ও গুণে সেরা। এত কোন দ্বিমত নেই।
কোন ধরনের সরিষার তেল স্বাস্থ্যকর?
একমাত্র কোলপ্রেস
পদ্ধতিতে তৈরি কাঠের ঘানিতে ভাঙ্গানো সরিষার তেলেই স্বাস্থ্যমান অক্ষুণ্ণ থাকে।কোল্ডপ্রেস
মানে হচ্ছে অল্প তাপমাত্রায় তেল ভাঙ্গানো।যা একমাত্র কাঠের ঘানিতেই সম্ভব। কাঠের ঘানির
মধ্যেও তেঁতুল কাঠের ঘানির তেল বেশী ভালো।
সরিষার তেলের পুষ্টি উপাদান
সরিষার তেলে
অনেক প্রয়োজনীয় ও পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান রয়েছে। যা আমাদের ত্বক ও স্বাস্থ্যের জন্য
খুব উপকারী। এর মধ্যে আছে প্রোটিন, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স,
ওমেগা, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং পরিমাণমতো ভিটামিন এ। এছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন
আছে যা নতুন চুল গজাতে ও চুলের গোঁড়া মজবুত করতে অত্যন্ত কার্যকরী।
সরিষার তেলের উপকারিতা
সরিষার তেলের
বিস্তৃত উপকারিতার জন্য এর প্রচলন শুধু রান্নায় ও ব্যবহারেই নয়, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে
চিকিৎসায়ও রয়েছে। তাই যারা এর সঠিক গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা এখনও নিয়মিত
সরিষার তেল ব্যবহার করে চলেছেন। আর যারা এই তেলের গুণাগুণ সম্পর্কে তেমন একটা জানেন
না, তাদের জন্য সরিষার তেলের কিছু উল্লেখযোগ্য উপকারিতা নিচে তুলে ধরা হলঃ
রান্না হয় স্বাস্থ্যকর
সরিষার তেলের
রান্নায় যেমন স্বাদ বেশী হয় তেমনি রান্নাকৃত খাদ্যের পুষ্টিমান থাকে অক্ষুন্ন।সয়াবিন,সানফ্লাওয়ার
কিংবা রাইসব্রান ওয়েল এর তুলনায় সরিষার তেলের রান্না অনেক স্বাস্থ্যসম্মত।কোল্ডপ্রেস
সরিষার তেলে রান্না করা খাবার খেলে গ্যাস্ট্রিক বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে
চলে আস।
ত্বক উজ্জ্বল করে
সরিষার তেল
ত্বকের কালচে ভাব দূর করে প্রাকৃতিকভাবে ত্বককে উজ্জ্বল করতে পারে। এ জন্য বেসন, দই,
সরিষার তেল ও কয়েক ফোঁটা লেবুর রস একসঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট বানান। আপনার ত্বকে এই পেস্টটি
প্রায় ১০-১৫ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। এরপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে তিনবার
ব্যবহার এভাবে ব্যবহার করলেই আপনার ত্বকে ভিন্নতা ও উজ্জ্বলতা লক্ষ্য করতে পারবেন।
প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন
সরিষার তেলে
প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ই থাকে। যা গায়ে মাখলে ত্বক সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি
এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ থেকে সুরক্ষিত থাকে। এই ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ত্বকে
ক্যানসার হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। যা প্রতিরোধে সরিষার তেল কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
এছাড়া ভিটামিন ই বলিরেখা ও বয়সের ছাপ দূর করে তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়তা করে করে। তাই
আপনার ত্বকের যত্নে সানস্ক্রিন লোশনের মতোই ব্যবহার করতে পারেন এই সরিষার তেল।
চুলের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে
সাধারণত চুলের যত্নে আমরা নারিকেল তেল বা জলপাই তেলের ব্যবহারটাই বেশি দেখি। কিন্তু চুলের সুস্বাস্থ্য বজায়ে সরিষার তেলের ভূমিকাও কম নয়। সরিষার তেলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ থাকে যা চুলের বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা করে। নিয়মিত মাথার তালুতে সরিষার তেল ব্যবহারের ফলে অকালে চুল সাদা হওয়া ও চুল পড়া বন্ধ হয়। এছাড়া সরিষার তেলে থাকা উচ্চমাত্রার বিটা ক্যারোটিন চুলের গোঁড়া মজবুত করে চুল স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রাখে। সরিষার তেলে আরও বিদ্যমান আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফ্যাটি অ্যাসিড ও ম্যাগনেশিয়াম চুলের বৃদ্ধির পাশাপাশি চুল কালো করতেও অত্যন্ত কার্যকরী।
উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে
সরিষার তেল
পরিপাক তন্ত্র, রক্ত সংবহন তন্ত্র ও রেচন তন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
এটি নিয়মিত শরীরে মালিশ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ত্বরান্বিত হয়। যা শরীরে রক্ত জমাট
বাঁধতে দেয় না এবং শরীরের সারা দিনের ক্লান্তি ভরা পেশিগুলো উজ্জীবিত এবং সবল রাখে।
এছাড়া এটি পরিপাক তন্ত্রে ক্ষুধা সৃষ্টি করে খাবারের রুচি বাড়ায়।
ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে
সরিষার তেলে
গ্লুকোসিনোলেট নামক ক্যানসার বিরোধী উপাদান থাকে যা ক্যানসারজনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে
সাহায্য করে। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল শরীরকে ক্যানসার
থেকে সুরক্ষা দেয় ও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়
সরিষার তেলে
আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যা শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে তোলে। তাই যাদের হার্টের
সমস্যা রয়েছে তারা খাবারে পরিমাণ মত সরিষার তেল ব্যবহার করে খেতে পারেন। এতে হার্ট
ভাল থাকবে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমবে।
ব্যাথা দূর করে
অনেকেই আছেন
যারা জয়েন্টের ব্যথা, আর্থ্রাইটিস রোগসহ নানা কারণে ব্যথায় জর্জরিত হয়ে থাকেন। ব্যথা
দূর করতে পেইনকিলার নিতে হয় যা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। তারা সরিষার তেল ব্যবহার করে
দেখতে পারেন। কারণ এতে এমন উপাদান রয়েছে যা প্রদাহজনিত উৎসেচকের ক্রিয়ার গতি কমিয়ে
তোলে। ফলে ব্যথার থেকে আরাম পাওয়া যায়।
এসকল ব্যথা
থেকে পরিত্রাণ পেতে সরিষার তেলে পরিমাণমতো কর্পূর মেশান। চুলার তাপে বা রোদে তেল হালকা
গরম করে ঠান্ডা করে নিন। এবার সেই তেল দিয়ে ব্যথার স্থানে মালিশ করুন। দেখবেন দ্রুতই
ব্যথা নিরাময় হবে এবং আরাম পাবেন।
ঠান্ডা লাগা দূর করে
ঠান্ডা লাগার
কারণে আমরা সচরাচর ডাক্তার দেখাই না। এক্ষেত্রে বুকে কফ জমা স্থানে সরিষার তেল দিয়ে
মালিশ করলে বুকের কফ দূর হয়ে যাবে। অনেকের আবার ঠান্ডা লেগে নাক বন্ধ হয়ে যায়। সেই
ক্ষেত্রে বন্ধ নাক খোলার জন্য এক বাটি পানিতে কয়েক ফোঁটা সরিষার তেল ফেলুন। এবার পানি
একটু গরম করে ভাপ নিন। দেখবেন বন্ধ নাক খুলে গেছে শ্বাস প্রশ্বাস সচল রাখবে। ছোট বাচ্চাদের
ক্ষেত্রে বুকে বা পায়ের তলায় সরিষার তেল দিয়ে এই মালিশ খুবই উপকারী ও ফলপ্রসূ।
খাঁটি সরিষার তেল চেনার উপায়
খাঁটি সরিষার
তেল বলতে সাধারণত ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলকেই বোঝায়। যা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে কাঠের
ঘানি দ্বারা সরিষা পিষ্ট করে বের করা হয়। এই দেশীয় পদ্ধতিতে নিঃসরণকৃত সরিষার তেলে
ঝাঁজ হয় খুবই কম কিন্তু সুঘ্রাণ হয় তীব্র। অপরদিকে, ইলেকট্রিক কলে পিষ্ট হয়ে ও অনেকটা
পুড়ে যে সরিষার তেল বের হয়, সেই তেলই বাজারে বেশি পাওয়া যায়। যার সুঘ্রাণ তীব্র না
হলেও ঝাঁজ থাকে অনেক বেশি। তাই খাঁটি তেলের স্বাদ ও উপকার পেতে ঘানি ভাঙ্গা সরিষার
তেল ব্যবহার করুন।
পরিশেষে
সরিষার তেল
এদেশের ঐতিহ্য ও গ্রাম-বাংলার মানুষের সাথে বহুকাল ধরেই মিশে আছে। একসময় গ্রামবাংলার
একমাত্র ভোজ্যতেল ছিল সরিষার তেল। এর স্বাদ ও গুণাগুণের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ
চিকিৎসায় সুপরিচিত এটি। কিন্তু বর্তমানে খাঁটির নিশ্চয়তা না থাকায় সরিষার তেলের চাহিদা
থাকলেও ব্যবহার কমে গেছে। তাই আমরা বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রেখে এদেশের মানুষের কাছে খাঁটি
ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছি। উন্নতজাতের সরিষা বীজ সংগ্রহ করে
কাঠের ঘানিতে প্রথম চাপে সরিষা তেল বের করে অর্গানিক পদ্ধতিতে পরিশোধন করা হয়। ফলে
এর থেকে পাওয়া যায় সঠিক স্বাদ ও উপকারিতা। তাই আপনার ও আপনার পরিবারের সুস্বাস্থ্যে
খাঁটি ঘানিভাঙ্গা সরিষার তেল ব্যবহার করুন।
সতর্কতা
সরিষার তেল
ব্যবহারের আগে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে জেনে নিতে হবে যে আপনার সরিষার তেল খাঁটি কি না?
নকল বা ভেজাল সরিষার তেল ব্যবহারের ফলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। নিশ্চয়ই বুঝতে
পারছেন আমাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষায় সরিষার তেল কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু
যেকোনো সরিষার তেল কি আমাদের জন্য উপকার বয়ে আনবে? মোটেও তা নয়। দোকানের খোলা সরিষার
তেলে ভেজাল মিশ্রিত থাকে, যা ব্যবহার করলে নানা রকম অসুখ–বিসুখ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তাই খাঁটি সরিষার কেনার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে।